ডাউন সিনড্রোম কি?


ডাউন সিনড্রোম কি?

আমাদের শরীরে প্রত্যেকটি কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৬ টি। এর মধ্যে ২৩ টি ক্রোমোজোম বাবা এবং অন্য ২৩ টি ক্রোমোজোম মা এর কাছে থেকে আসে, যা জোড়ায় জোড়ায় দেহকোষ তৈরি করে। যখন কোনো কারনে এই ২৩ জোড়া ক্রোমোজমের ২১তম জোড়ায় ১টি অতিরিক্ত ক্রোমোজমের উপস্থিতি থাকে (যাকে ‘Trisomy 21’ বলা হয়) তখন  জন্মগ্রহনকারী শিশু একধরণের স্নায়ু বিকাশজনিত প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়, যা ‘ডাউন সিনড্রোম’ নামে পরিচিত। এভাবে ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তির শরীরে প্রত্যেকটি কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা দাড়ায় ৪৭ টি। এই অতিরিক্ত ক্রোমোজোমের উপস্থিতির কারনে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় (Delay Development) এবং বুদ্ধিমাত্রার ঘাটতি থাকে, কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, এবং নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়
বাংলাদেশের নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন  ২০১৩ –শীর্ষক আইনদ্বয়ে প্রদত্ত সংগা অনুসারে, “কোনো ব্যক্তির মধ্যে এইরূপ কোনো বংশানুগতিক (genetic) সমস্যা, যাহা ২১ তম ক্রমোসোম জোড়ায় একটি অতিরিক্ত ক্রমোসোমের উপস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, এবং মৃদু হইতে গুরম্নতর মাত্রার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, দুর্বল পেশীক্ষমতা, খর্বাকৃতি ও মঙ্গোলয়েড মুখাকৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হইলে, তিনি ডাউন সিনড্রোমসম্পন্ন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বলিয়া বিবেচিত হইবেন।”

কিছু তথ্যঃ

১। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, ডাউন সিন্ড্রোম বংশগত হয় না।
২। গবেষণায় দেখা গেছে, যত বেশি বয়সে মা হবেন, সন্তানের ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মের আশঙ্কা তত বেশি। ২৫ বছর বয়সী প্রতি ১ হাজার ২শ’ গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজন, ৩০ বছর বয়সী প্রতি ৯শ’ জনের মধ্যে একজন, আর ৪০ বছর বয়সী প্রতি এক শ’ মায়ের মধ্যে একজনের ডাউন শিশু হতে পারে।
৩। ২১ শে মার্চ হলো "ডাউন সিনড্রোম দিবস"। ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি হয়েছে এভাবেঃ ২১ নম্বর জোড়ায় ৩ টি ক্রোমোজেম, তাই ২১ তারিখ ৩য় মাসের।
৪। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ৮শ’ শিশুর মধ্যে একজন ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্মগ্রহণ করে থাকে।
৫। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৭ মিলিয়ন ডাউন সিনড্রোম লোক রয়েছে।
৬। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজার বা প্রতিদিন প্রায় ১৫টি ডাউন শিশুর জন্ম হয়। ২৭/০২/২০১৯ তারিখ পর্যন্ত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজকেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধী সণাক্তকরণ জরিপ অনলাইন ডাটাবেজের (https://www.dis.gov.bd/bn/) তথ্য অনুযায়ী ৩৫৪৯ জন ডাউন সিনড্রোম প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নথিভূক্ত হয়েছেন। যদিও বর্তমানে দেশে ২ লাখ ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তি বসবাস করছে বলে ধারণা করা হয়।

ইতিহাসঃ

উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে মানুষ এই রোগটি সম্পর্কে কিছুই জানতো না। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সারে শহরের একটি মানসিক প্রতিবন্ধী আবাসনের দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা জন ল্যাংডন ডাউন খেয়াল করেন, প্রতিবন্ধীদের মধ্যে একাংশ চেহারায় অন্যদের থেকে একটু আলাদা। তাদের মুখ একটু চ্যাপ্টা এবং ঘাড়টা ছোট। তিনি তাদের নাম 'মোঙ্গলয়েড' রাখেন। এরপর থেকে এটি ডাউন সিন্ড্রোম নামে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্থান পায়। জনাব ডাউন স্বতন্ত্র এবং আলাদাভাবে এই রোগের অস্তিত্ব বর্ণনা করেন। এজন্যই তাকে 'ডাউন সিনড্রোমের জনক' বলা হয়। যদিও এর কারণ যে, অতিরিক্ত একটি ক্রোমোজমের উপস্থিতির কারনে তা, ১৯৫৯ সালে ফ্রান্সের চিকিৎসক জেরমি লিজেউন আবিষ্কার করেন। তিনিই এই রোগকে ক্রোমোজোমাল ব্যাধি হিসেবে শনাক্ত করেন।

জন্মের পূর্বেই ডাউন সিনড্রোম জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হল ক্রোমোসোম পরীক্ষা (karyotype) সম্পন্ন করা। রক্ত কোষে ক্রোমোসোম বিশ্লেষণ করে এটি করা হয়।

শারীরিক লক্ষণঃ

• জন্মের সময় শিশুর ওজন ও উচ্চতা, গড় ওজন ও উচ্চতার চেয়ে কম থাকে।
• মুখমন্ডল, বিশেষত নাকের অংশটি চ্যাপ্টা থাকে।
• গলা ও কান তুলনামূলক ছোট আকৃতির হয়ে থাকে।
• সবসময় মুখ দিয়ে জিহ্বা বের হয়ে ঝুলতে থাকে।
• পেশী ও অস্থিসন্ধিগুলো দুর্বল ও শিথিল হয়।
• হাত দৈর্ঘ্যে ছোট কিন্তু চওড়া হয় এবং তালুতে মাত্র একটি রেখার উপস্থিতি দেখা যায়।
• দাঁতের গোড়া ছোট এবং কৌণিক আকৃতি হয়ে থাকে।

অনেক সময় ডাউন সিনড্রোমের সঙ্গে হার্টের সমস্যা, থাইরয়েডের সমস্যা থাকতে পারে। এছাড়াও ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের কিছু জন্মগত বিকৃতি এবং জটিলতা থাকতে পারে। –
• কানে সংক্রমণের ফলে বধিরতা বা কানে না শোনা।
• ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি অথবা ক্যাটারাক্ট।
• থাইরয়েড, অন্ত্র ও হৃদপিণ্ডে সমস্যা
• অ্যানিমিয়া বা শরীরে রক্তের স্বল্পতা।
• লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার।
• ওবেসিটি বা শরীরে মেদ বৃদ্ধি।
• জন্মের সময় জিহ্বায় ফোলাভাব, যা থেকে পরবর্তীতে ফিসারড টাং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
• স্থায়ী দাঁত উঠার সময় বিলম্ব হওয়া।
• দাঁত তাড়াতাড়ি পড়ে যাওয়া।
• মুখে অ্যাপথাস আলসার, ওরাল ক্যান্ডিডা সংক্রমণ এবং আলসারযুক্ত মাড়ি রোগ দেখা দেয়া।
সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার মাধ্যমে এ সমস্ত সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে শারীরিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

চিকিৎসাঃ


এটি একটি জীবনব্যাপী সমস্যা। কিন্তু দ্রুত চিকিৎসা শুরু করালে এবং থেরাপির সাহায্যে শিশুর জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যেতে পারে।
আর্লি ইন্টারভেনশন প্রোগ্রামঃ
ডাউন সিনড্রোমের সমস্ত লোকেরা অন্য শিশুদের তুলনায়, শারীরিক ও মানসিকভাবে দেরিতে বেড়ে ওঠে। বসতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে বা কথা বলতে শেখে দেরিতে। আবার কেউ কেউ এ রকম এক বা একাধিক কাজ কখনোই শেখে না।
উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বড় করতে পারলে ডাউন শিশুরা কর্মক্ষম হয়ে অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারে।

ফিজিওথেরাপিঃ

    • নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
    • হাঁটাচলা এবং নড়াচড়ায় অসুবিধা দূর হয়।
    • ইন্দ্রিয়ের সচেতনতা (যেমন: দৃষ্টি, শ্রবণ ও স্পর্শক্ষমতা) বৃদ্ধি পায়।
    • মোবিলিটি এক্সারসাইজ এবং স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের                      শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।
    • ফাইন মোটর ও গ্রস মোটর ট্রেনিং এবং এক্সারসাইজ এর মাধ্যমে দক্ষতার উন্নয়ন করা সম্ভব, যা কি না ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্তকে তার দৈনন্দিন কাজকর্ম তথা কর্মপোযোগী করে তুলে;
অকুপেশনাল থেরাপিঃ
    • নিজে নিজে বিভিন্ন অর্থপূর্ণ কাজ করতে শেখে।
    • নিজের যত্ন নিজে নিতে শেখে।
    • গৃহস্থালীর কাজ (যেমন রান্না করা, কাপড় ধোয়া) করতে সক্ষম হয়।
    • বিনোদনমূলক কাজে উৎসাহী হয়।

স্পিচ থেরাপিঃ

    • যোগাযোগ দক্ষতার উন্নতি ঘটে।
    • ভাষাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়।
    • শব্দভান্ডার বৃদ্ধি পায়।
আচরণগত থেরাপি
    • মানসিক এবং আচরণগত সমস্যাগুলি পরিচালনার উপর জোর দেয়। এই থেরাপিটি পরিবারকে শেখানোর জন্য কিভাবে ডাউন সিন্ড্রোম সহ একটি সন্তানকে রাগ বা হতাশা মোকাবেলা করতে সাহায্য করতে পারে।

প্রতিরোধে করণীয়ঃ

• গর্ভকালীন সময় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে।
• ওষুধ গ্রহণে সতর্কতা থাকতে হবে।
• প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করতে হবে।
• জন্মের পর শিশুদের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
• স্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুকে লালন-পালন করতে হবে।
• বেশি বয়সে সন্তান ধারণ রোধ করতে হবে।








Ref:

1. Therapies and rehabilitation in Down syndrome / edited by Jean-Adolphe Rondal, Alberto Rasore Quartino. (John Wiley & Sons Ltd 2007)
2. Children with Down’s Syndrome Motor Development and Intervention / Peter E.M. Lauteslager, PhD (Thesis University Utrecht, The Netherlands 2000)
3. Children with disabilities / edited by Mark L. Batshaw, Nancy J. Roizen, and Gaetano R. Lotrecchiano.—7th ed. (Paul H. Brookes Publishing Co. 2013)
4. Disabled Village Children / David Werner (The Hesperian Foundation 2009)
5. Handbook of Intellectual and Developmental Disabilities / Edited by John W. Jacobson,† James A. Mulick, and Johannes Rojahn (Springer Science+Business Media, LLC 2007)

1 comment:

Powered by Blogger.